শবে বরাতের ফজিলত, গুরুত্ব, আমল ও হাদিস
শবে বরাত হলো এমন একটি দিন, যে দিনে আল্লাহ তা'আলা আমাদের জন্য বরকতময় দিন ও রাত দিয়েছেন। শবে বরাতের দিনে ও রাতে ইবাদত করলে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা সম্ভব। এই আর্টিকেলে এই রাতের ফজিলত, গুরুত্ব ও আমল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
শবে বরাত কি?
ফারসি ভাষায় ‘শব’ অর্থ রাত এবং বরাত অর্থ ভাগ্য। তাহলে শবে বরাত শব্দের অর্থ হলো ভাগ্যরজনী। শবে বরাতের রাতে মানুষের ভাগ্য লেখা হয়, তাই শবে বরাতকে ভাগ্যরজনী বলা হয়।
হজরত ইকরামা (রা:) থেকে বর্ণিত, শবে বরাতের রাতে আগামী এক বছরের রিজিক আল্লাহ তা'আলা নির্ধারণ করেন। আগামী এক বছরে যে সকল মানুষ মারা যাবে এবং জন্মগ্রহণ করবে, তাদের তালিকা এ রাতে হিসেব করা হয়।
শবে বরাত শব্দের আরবি পরিভাষায় "লাইলাতুল বারাআত" বলা হয়। লাইলাতুন শব্দের অর্থ হলো রাত এবং বরাআত শবদের অর্থ হলো মুক্তি, ক্ষমা ইত্যাদি। শবে বরাতের রাতে আল্লাহ তা'আলা অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন, তাই এই রাতকে মুক্তির রজনী বলা হয়।
হাদিসে শবে বরাতের রাতকে "লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান" বা শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাত নামে অভিহিত করা হয়েছে।
শবে বরাতের ফজিলত ও গুরুত্ব
শবে বরাতের ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক হাদিস রয়েছে। নিম্নে ৩ টি হাদিস দেওয়া হলো-
শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে ইবন মাজাহ হাদিস নাম্বার ১৩৮৮ : শবে বরাত হলো এমন একটি রাত, যে রাত হলো বরকতময় ও ফজিলতপূর্ণ। এ রাতে আল্লাহ তা'আলা পাপী বান্দাদের ক্ষমা করে দেন। রাসুল (সা:) বলেন, যখন শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাত আসবে, তখন তোমরা এ রাতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে এবং দিনে রোজা পালন করবে। কারণ এই দিন সূর্যাস্ত হওয়ার পর আল্লাহ তা'আলা দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, "কে আছো ক্ষমাপ্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কে আছো রিজিকপ্রার্থী, আমি তাকে রিজিক দেব। কে আছো বিপদগ্রস্ত, আমি তাকে বিপদমুক্ত করব।" ফজর হওয়া আগে পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা এ কথা বলতে থাকেন।
শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে ইবন মাজাহ হাদিস নাম্বার ১৩৮৯ : শবে বরাতের রাতে আল্লাহ তা'আলা বান্দাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। রাসুল (সা:) বলেন, শবে বরাতের রাতে আল্লাহ তা'আলা বনু কালবের ছাগলগুলোর পশমের চেয়ে বেশিসংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করেন।
শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে ইবন মাজাহ হাদিস নাম্বার ১৩৯০ : শবে বরাতের এই রাতে এমন কিছু লোক আছে যারা এই রাতে ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হয়। রাসুল (সা:) বলেন, শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতে আল্লাহ তাঁর সকল বান্দাকে ক্ষমা করেন। তবে মুশরিক, হিংসুক, জাদুকর, ব্যভিচারী, মা-বাবার অবাধ্য সন্তান ও অন্যায়ভাবে হত্যাকারী বান্দাকে ক্ষমা করেন না।
শবে বরাতের আমল
শবে বরাতে দিনে ও রাতে বিশেষ কিছু আমল আছে, যে করলে বান্দা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য লাভে করে। শবে বরাতের রাতে করণীয়গুলোর নিম্নে দেওয়া হলো-
শবে বরাতের দিনে রোজা রাখা : রাসুল (সা:) ইবনে মাজাহ শরীফের ১৩৮৮ নাম্বার হাদিসে বলেন এই দিন রোজা রাখতে।
শবে বরাতের রাতে নফল নামাজ পড়া : শবে বরাতে বেশি বেশি নফল নামাজ আদায়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইমাম গাজ্জালি (রহ:) থেকে বর্ণিত, এই রাতে ১০০ রাকাত নফল নামাজ আদায়ের উপদেশ দিয়েছেন।
শবে বরাতের রাতে কোরআন পাঠ করা : এই রাতে বেশি বেশি করে কোরআন তিলাওয়াত করলে অনেক সওয়াবের পাওয়া যায়। শবে বরাতের রাতে কোরআন এর একটি অক্ষর পাঠ করলে ১০টি নেকি পাওয়া যায়।
শবে বরাতের রাতে দোয়া করা : মিরকাত ৩/১৯৭ নাম্বারে এসেছে, এই রাতে দোয়া পাঠ করা হলো উত্তম কাজ। ২ টি দোয়া নিম্নে দেওয়া হলো-
১. শবে বরাতের রাতে দোয়া : আল্লাহম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাফু আন্নি।
অর্থ : হে আল্লাহ, তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা পছন্দ করো, অতএব আমাকে ক্ষমা করে দাও।
২. শবে বরাতের রাতে দোয়া বাংলাই : হে আল্লাহ, আপনি যদি আমাদের নাম দুর্ভাগ্যদের মধ্যে লিখে রাখেন, তবে তা মুছে দিয়ে সৌভাগ্যবানদের মধ্যে লিখে নিন। আর যদি আমাদের নাম সৌভাগ্যবানদের মধ্যে লিখে থাকেন, তবে তা স্থির রাখুন। কারণ আপনার কাছেই রয়েছে মূল কিতাব।
শবে বরাতের রাতে কবর জিয়ারত করা : ইবনে মাজাহ শরীফে ১৩৮৯ নাম্বার হাদিসে এসেছে, এ রাতে রাসুল (সা:) জান্নাতুল বাকিতে উম্মতের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেছেন। হজরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত, একদা এক রাতে আমি রাসুল (সা:) কে না পেয়ে খুঁজতে থাকি। এরপর, আমি তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে দুহাত তোলা অবস্থায় পেলাম। এ থেকে আমরা এ রাতে কবর জিয়ারতের বিষয়টি সাব্যস্ত করতে পারি।
শবে বরাতের বর্জনীয় কাজ
শবে বরাতের রাত আমাদের জন্য বরকতপূর্ণ রাত। এ রাতে কোনো নোংরা ও গর্হিত কাজ না করে আমাদের সঠিক আমল ও আল্লাহ তা'আলার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এই দিনে আমাদের দেশে প্রচলিত কিছু বর্জনীয় কাজ গুলো নিম্নে দেওয়া হলো-
শবে বরাতের দিন হালুয়া-রুটি তৈরি করা : আমাদের দেশে প্রায় সকল এলাকাই শবে বরাতের দিন হালুয়া রুটি তৈরি করা প্রচলিত আছে। তবে, এই কাজটির কোনো ভিত্তিহীন নেই।
শবে বরাতের দিন আলোকসজ্জা করা : আমাদের দেশে কোনো কোনো এলাকাতে শবে বরাতের রাতে অনেক বাড়িঘর, মসজিদ এবং ধর্মীয় স্থানে আলোকসজ্জার করা হয়। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে এ রাতের কোনো সম্পর্ক নেই। এই রাতে আমল ও আল্লাহ তা'আলার কাছে দোয়া করতে হবে। আলোকসজ্জা করা অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা'আলা একটি আয়াতে বলেন, তোমরা অপচয় কোরো না, নিশ্চয়ই অপচয়কারী শয়তানের ভাই।
শবে বরাতের দিন আতশবাজি ও পটকা ফোটানো : আমাদের দেশে কোনো কোনো এলাকাই এই দিনে মাথায় টুপি ও হাতে তসবিহ নিয়ে আতশবাজি এবং পটকা ফোটায়। এই সকল কাজের মাধ্যমে সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বৃদ্ধ ও শিশুরা ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারে না। তাই এসব করা ইসলামে হুকুম দেওয়া হয়নি। এই দিনে ও রাতে আমাদের আমল করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের আমল গুলো দেখবেন।
শবে বরাতের দিন ক্ষমার অযোগ্য পাপ না করা : আমরা জেনে অথবা না জেনে বিভিন্ন ধরণের পাপ কাজ করি। কিন্তু আল্লাহ এ মহিমান্বিত শবে বরাতের রাতে যেসব পাপীকে ক্ষমা করেন না, তাদের খাতায় আমাদের নাম রাখা যাবে না। যাদের কে আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা করবেন না, তারা হলো - হিংসুক, জাদুকর, গণক, মা-বাবার অবাধ্য, ব্যভিচারী প্রমুখ ব্যক্তি।