তারাবির নামাজের দোয়া, নিয়ম, নিয়ত, হাদিস, ফজিলত সহ বিস্তারিত

তারাবির নামাজের দোয়া

তারাবি শব্দের অর্থ কি আপনি জানেন? তারাবি আরবি শব্দ, তারাবি শব্দের অর্থ বিশ্রাম বা আরাম করা।


তারাবির নামাজের দোয়া সম্পর্কে আপনি জানেন কি? তারাবির দোয়া নামাজের মাঝে পাঠ করতে হয়। নিম্নে এই দোয়া কখন পাঠ করতে হয় দেওয়া হলো-

তারাবির নামাজের দোয়া কখন পড়তে হয় আপনি জানেন কি? তারাবির নামাজের ২ রাকাত এবং ৪ রাকাত পর পর দোয়া পাঠ করতে হয়।

তারাবির নামাজের দুই রাকাতের পর দোয়া

তারাবীহ নামাজে দুই রাকাআত পরপর এই দোয়াটি পড়ার প্রচলন রয়েছে।

তারাবির নামাজের দুই রাকাতের পর দোয়া আরবিতে : هذا من فصل ربى يا كريم المعروف يا قديم الاحسان احسن الينا باحسانك القديم ثبت قلوبنا على دينك برحمتك يا ارحم الرحمين.

তারাবির নামাজের দুই রাকাতের পর দোয়া বাংলায় : হা-যা মিং ফাদ্বলি রব্বী ইয়া কারীমাল মা’রূফ, ইয়া ক্বদীমাল ইহসান, আহসিন ইলাইনা বি ইহসানিকাল ক্বদীম। ছাব্বিত ক্বুলূবানা আলা দীনিকা বিরহমাতিকা ইয়া আরহামার রহিমীন।

তারাবির নামাজের চার রাকাত পরপর দোয়া

তারাবীহ নামাজে চার রাকাত পরপর এই দোয়াটি পড়ার প্রচলন রয়েছে।

তারাবির নামাজের চার রাকাত পরপর দোয়া আরবিতে : سبحان ذى الملك والملكوت سبحان ذى العزة والعظمة والهيبة والقدرة والكبرياء والجبروت . سبحان الملك الحى الذى لاينام ولا يموت سبوح قدوس ربنا ورب الملئكة والروح.

তারাবির নামাজের চার রাকাত পরপর দোয়া বাংলায় : সুবহানাজিল মুলকি ওয়ালমালাকুতি সুবহানাজিল ইজ্জাতি ওয়াল আজমাতি ওয়ালহাইবাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিবরিয়ায়ি ওয়াল জাবারুতি; সুবহানাল মালিকিল হাইয়্যিল্লাজি লা ইয়ানুমু ওয়া লা ইয়ামুতু, সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাববুনা ওয়া রাব্বুন মালাইকাতি ওয়ার রূহ।

অর্থ : আল্লাহ পবিত্রময় সাম্রাজ্য ও মহত্ত্বের মালিক। তিনি পবিত্রময় সম্মান মহত্ত্ব ও প্রতিপত্তিশালী সত্তা। ক্ষমতাবান, গৌরবময় ও প্রতাপশালী তিনি পবিত্রময় ও রাজাধিরাজ যিনি চিরঞ্জীব, কখনো ঘুমায় না এবং চির মৃত্যুহীন সত্তা। তিনি পবিত্রময় ও বরকতময় আমাদের প্রতিপালক, ফেরেশতাকুল এবং জিবরাইলের (আ.) প্রতিপালক।

তারাবির নামাজের নিয়ম আপনি জানেন কি? তারাবির নামাজের নিয়ম কানুন সঠিক ভাবে সকল মুসলিম ব্যক্তির জানা প্রয়োজন। তারাবির নামাজ পড়ার নিয়ম নিম্নে দেওয়া হলো-

তারাবিহ নামাজ ২ রাকাআত করে প্রতি ৪ রাকাআত পর খানিক বিশ্রাম গ্রহণ করা। এ সময় দোয়া করা। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা। পরবর্তী ৪ রাকাআত সুন্দরভাবে আদায়ের শক্তি গ্রহণ করা।

অনেকে প্রতি ৪ রাকাআত পর পর মুনাজাত দেয়। আবার অনেকে একেবারে নামাজ শেষ করে মুনাজাত দেয়। উভয়টিই করা যেতে পারে। এতে কোনো সমস্যা নেই।

তারাবিহ নামাজে ইমাম হোক আর মুসল্লি হোক প্রতিযোগিতা করে তারাবিহ পড়ার প্রবনতা পরিহার করা উচিত। কারণ যত তাড়াতাড়িই নামাজ পড়ার চেষ্টাই করা হোক না কেন, তাতে সময়ের ব্যবধানে বেশি হেরফের হয় না।

সুতরাং সামান্য সময়ের জন্য তারাবিহ নামাজের সৌন্দর্য বিনষ্ট করতে তাড়াতাড়ি তারাবিহ পড়ার প্রবনতা থেকে বেরিয়ে এসে অধিক ছওয়াব অর্জনের প্রত্যাশায় ধীর ও স্থিরভাবে তারাবিহ পড়াই উত্তম।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে খতম তারাবিহ হোক আর সুরা তারাবিহ হোক; সব তারাবিহ নামাজ ধীরস্থিরভাবে পড়ার তাওফিক দান করুন। তারাবিহর ফজিলত লাভে নিয়মিত রাত জাগরণ করে তারাবিহ আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

তারাবির নামাজের নিয়ম কানুন মহিলাদের

পুরুষদের মতন মহিলাদের তারাবির নামাজ আদায় করতে হয়। মহিলাদের তারাবির নামাজের নিয়ম পুরুষদের মতোই, তবে মহিলারা ঘরে একাকি নামাজ আদায় করলেই হবে।

তারাবির নামাজের সময় কখন আপনি জানেন কি? তারাবির নামাজের সময় হলো এশার নামাজের পর। এশার নামাজের পর বেতের নামাজ না পরে তারাবির নামাজ আদায় করতে হয়। তারাবির নামাজ শেষ করে বেতের নামাজ আদায় করতে হয়।

তারাবির নামাজ কত রাকাত আপনি জানেন কি? তারাবি নামাজ কত রাকাত এর নির্দিষ্ট করে কোনো দলিল নেই। যারা হানাফি, শাফিয়ি ও হাম্বলি ফিকহের  অনুশরণ করে তারা ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করে। যারা মালিকি ফিকহের অনুসারণ করে তারা ৩৬ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করে এবং যারা আহলে হাদীস অনুশরণ করে তারা ৮ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করে।

তারাবির নামাজের নিয়ত আপনি জানেন কি? তারাবি নামাজের নিয়ত নিম্নে দেওয়া হলো-

তারাবির নামাজের নিয়ত আরবিতে : نويت ان اصلى لله تعالى ركعتى صلوة التراويح سنة رسول الله تعالى متوجها الى جهة الكعبة الشريفة الله اكبر.

তারাবির নামাজের নিয়ত বাংলা উচ্চারণ : নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা, রকাআতাই সালাতিত তারাবিহ সুন্নাতু রাসুলিল্লাহি তা’আলা, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারিফাতি, আল্লাহু আকবার।

তারাবির নামাজের নিয়ত বাংলায় : আমি ক্বিবলামুখি হয়ে দু’রাকাআত তারাবিহ সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ নামাযের নিয়ত করছি। আল্লাহু আকবার।

তারাবির নামাজের মোনাজাত সম্পর্কে আপনি জানেন কি? তারাবি নামাজের মোনাজাতে এই দোয়াটি পড়ার প্রচলন রয়েছে। দোয়াটি হলো -

আল্লা-হুম্মা ইন্না নাস আলুকাল্ জান্নাতা ওয়া নাউজুবিকা মিনান্নারি ইয়া খালিকাল জান্নাতা ওয়ান্নারি বিরাহমাতিকা ইয়া আজীজু, ইয়া গাফ্ফারু, ইয়া কারীমু, ইয়া সাত্তারু, ইয়া রাহিমু ,ইয়া জাব্বারু ইয়া খালেকু, ইয়া রাররূ, আল্লাহুমা আজির না উয়া খাল্লিসনা মিনান্নারি, ইয়া মূজিরু, ইয়া মূজিরু, ইয়া মুজিরু, বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন।

তারাবির নামাজ সুন্নত নাকি নফল আপনি জানেন কি? তারাবির নামাজ কি সুন্নত না নফল এটি আমরা অনেকে জানি না। তারাবির নামাজ নারী ও পুরুষের জন্য সুন্নতে মুয়াক্কাদা।

তারাবির নামাজ কি আপনি জানেন কি? তারাবির নামাজ বা কিয়ামুল লাইল হলো রমজান মাসে রাতের বিশেষ সুন্নত নামাজ। বড় তেলোয়াত করে এই নামাজ আদায় করা হয়।

তারাবির নামাজ না পড়লে কি গুনাহ হবে কি আপনি জানেন? তারাবির নামাজ হলো সুন্নতে মুআক্কাদা, কোনো বিশেষ কারণ ছারা এই নামাজ আদায় করা উত্তম।

তারাবির নামাজ না পড়লে কি রোজা হবে কি আপনি জানেন। তারাবির নামাজ না পড়লে রোজা হবে, তবে এই নামাজ আদায় করা উত্তম। আপনি রমজান মাসে সকল তারাবির নামাজ আদায় করলে কোরআন খতম করার সোয়াব পাবেন। মহানবি (সা.) রমজান মাসে তারাবি নামাজ আদায় করার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করতেন।

তারাবি নামাজের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াব প্রাপ্তির আশায় রমজানের রাতে তারাবি নামাজ আদায় করে, তার অতীতকৃত পাপগুলো ক্ষমা করা হয়।’ (বুখারি শরিফ, মুসলিম শরিফ)

পবিত্র মাহে রমজানে রোজা, তারাবি নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদতের দরুন আল্লাহ তাআলা রোজাদার ব্যক্তির পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমাণ ও আত্মবিশ্লেষণের সঙ্গে পুণ্য লাভের আশায় রোজা রাখেন, তারাবি নামাজ পড়েন এবং কদরের রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত করেন, তাঁর জীবনের পূর্বের সব গুনাহ মাফ করা হবে।’ (বুখারি শরিফ,মুসলিম শরিফ)

রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বদা তারাবি নামাজ আদায় করতেন। তবে তিনি মাত্র চার রাত তারাবি নামাজ জামাতে পড়েছিলেন; কারণ যদি তিনি সর্বদা জামাতে তারাবি নামাজ আদায় করেন, তাহলে তাঁর উম্মতেরা ভাববে , হয়তো এ তারাবি নামাজ ফরজ।

হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) দুই রাতে ২০ রাকাত করে তারাবি নামাজ পড়িয়েছেন।

তৃতীয় রাতে লোকজন জমা হলেও রাসুলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত হননি। পরদিন সকালে তিনি ইরশাদ করলেন, ‘আমি তোমাদের ওপর তারাবি নামাজ ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছি। তখন তা তোমাদের জন্য কষ্টকর হবে।’

তবে কেউ যদি তারাবির নামাজ ছেড়ে দেয়, সেক্ষেত্রে রোজার উপর এর কোন প্রভাব পরবে না । কেননা রোজা ও তারাবি দুটি ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র ইবাদত ।

তারাবির নামাজের ফজিলত সম্পর্কে আপনি জানেন কি? তারাবির নামাজের ফজিলত সম্পর্কে একটি হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেন, "(হে আমার উম্মতগন), তোমরা জেনে রেখ আল্লাহ তোমাদের উপর রমজানের রোজা ফরজ করেছেন এবং উহার রাত্রে তারাবীহের নামাজ সুন্নাত করেছেন। অতএব, যে ব্যক্তি খালেস নিয়তে ঈমানের সাথে কেবল সোয়াবের আশায় এ মাসে দিনের বেলায় রীতিমত রোজা রাখবে এবং রাত্রিতে রীতিমত তারাবীহের নামাজ পড়বে তার বিগত সব সগীরা গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।" অতএব, এ পবিত্র মাসে অধিক নেকী অর্জন করে লওয়া উচিৎ। এ মাসের একটি ফরজ অন্য মাসের ৭০টি ফরজের সমান নেকী পাওয়া যায়।

তারাবির নামাজের ইতিহাস

রোজার সঙ্গে সঙ্গে যে ইবাদতের নাম সর্বাগ্রে আসে তা হলো তারাবির নামাজ। ‘তারাবি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বিশ্রাম বা আরাম। তারাবির নামাজ মূলত তাহাজ্জুদ নামাজেরই আরেকটি নাম। কিন্তু রমজান মাসে সর্বসাধারণ যেন এ থেকে কল্যাণকামী হতে পারে তাই রাতের প্রথম ভাগে অর্থাৎ এশার নামাজের পরপরই এ নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

তারাবির নামাজ সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, “একদিন গভীর রাতে মহানবি (সা.) মসজিদে গেলেন এবং নামাজ পড়লেন। কিছু লোকও নবিজীর পেছনে তখন নামাজ পড়লেন। ভোর হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরাম পরস্পরের সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করায় দ্বিতীয় রাতে লোকসংখ্যা আরও বেড়ে গেল এবং তারা মহানবির (সা.) সঙ্গে নামাজ পড়ল। সেদিন ভোর হওয়ার পর লোকদের মধ্যে আরও বেশি আলোচনা হলো এবং তৃতীয় রাতে মসজিদের লোক সমাগম আরও বেশি হলো। মহানবি (সা.) বাইরে বের হয়ে নামাজ পড়লেন আর তারাও নবিজীর সঙ্গে নামাজ পড়লেন। যখন চতুর্থ রাত এলো তখন এত লোক সমাগম হলো যে, মসজিদে স্থান সংকুলান হলো না। কিন্তু তিনি এ রাতে তারাবির নামাজের জন্য বের হলেন না। ভোর হলে ফজরের নামাজের জন্য বের হলেন এবং ফজরের নামাজ শেষে লোকদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাশাউদ পাঠের পর বললেন- তোমাদের বিষয়টি আমার কাছে গোপন ছিল না। কিন্তু আমি আশঙ্কা করছিলাম, এ নামাজ না আবার তোমাদের ওপর ফরজ করে দেওয়া হয়। আর তোমরা তা পালনে ব্যর্থ হও। মহানবি (সা.) ইন্তেকাল করলেন এবং এ নামাজের বিষয়টি তেমনই রইল”। (বুখারি)।

মহানবি (সা.) নিজে তারাবি নামাজ পড়েছেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে পড়ার জন্য আদেশ দিয়েছেন। তারাবি নামাজের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে উল্লেখ আছে, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের আশায় রমজানে তারাবির নামাজ আদায় করে তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়’। (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ)। হযরত আমর বিন মুররাহ আল-জুহানী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- “কুযাআ’হ গোত্রের এক ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলল- হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি এই মর্মে সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহ ছাড়া (ইবাদতের উপযুক্ত) কোনো উপাস্য নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসুল, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করি, রমজান মাসের সিয়াম পালন করি, তারাবিহ সালাত আদায় করি ও জাকাত প্রদান করি, তাহলে আমার ব্যাপারে আপনার মতামত কি? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘যে ব্যক্তি এর উপর মৃত্যুবরণ করবে সে সত্যবাদী ও শহীদদের মধ্যে গণ্য হবে”। (ইবনে খুযায়মা, ইবনে হিব্বান, তারগীব)

আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা পেতে হলে নফল ইবাদত একান্ত প্রয়োজন। আমরা যেন পবিত্র এই রমজানে ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি অনেক বেশি নফল ইবাদত করতে পারি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।

তারাবির নামাজে তাড়াহুড়ো করার বিধান কি?

তারাবির নামাজ আদায়ে অতি মাত্রায় তাড়াহুড়ো করা এবং তারাবির নামাজ আদায়ে অবহেলা করা একটি শরিয়ত পরিপন্থী কাজ। যেমন, মুরগির ঠোকর দেয়ার মত করে নামাজ আদায় করা এবং তারাবির নামাজে কোরান খতম করার উদ্দেশ্যে তাড়াতাড়ি কিরাত পড়া। শেখ জামাল উদ্দিন আল কাসেমি রহ. বলেন, মনে রাখতে হবে, তারাবির নামাজ রমজান মাসে অবশ্যই সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ, অধিকাংশ মসজিদের ইমামদের দেখা যায়, তারা তাদের মসজিদ সমূহে তারাবির নামাজ তাড়াহুড়ো করে তারাবির নামাজ আদায় করতে অভ্যস্ত। ফলে তারা নামাজের আরকান সুন্নাত ইত্যাদি আদায়ে অবহেলা করে। নামাজ তাড়াহুড়ো করে শেষ করার প্রবণতায় তারা রুকু সেজদা আদায়ে ধীরস্থিরতা ছেড়ে দেয়, কিরাত পড়তে তাড়াহুড়ো করে এবং কোরানের আয়াতের শব্দগুলোকে পরিবর্তন করে ফেলে।

এ ধরনের নামাজ এবং নেক আমল দ্বারা শয়তান ঈমানদারদের ধোঁকা দেয়া ও তাদের বোকা বানানোর চক্রান্ত। শয়তান তাদের আমল করা সত্ত্বেও আমলটিকে নষ্ট করে দেয় এবং যারা এ ধরনের তাড়াহুড়োর অনুকরণ করে, তাদের নামাজ অনেক সময় ইবাদতের পরিবর্তে তা হাসি ঠাট্টায় পরিণত হয়। তাই আমরা বলি, একজন মুসলি¬র উপর কর্তব্য হল, সে তার নামাজের বাহ্যিক যেমন: কিরাত, দাঁড়ানো, রুকু-সেজদা ইত্যাদি এবং আধ্যাত্মিক যেমন: একাগ্রতা, অন্তরের উপস্থিতি, পরিপূর্ণ ইখলাস, কিরাত এবং নামাজের তাসবিহ ইত্যাদির অর্থের মধ্যে চিন্তা ফিকির করা। নামাজের বাহ্যিক সৌন্দর্য হল, মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত আর নামাজের বাতিনি সৌন্দর্য, সৌন্দর্য নামাজির অন্তর বা আত্মার সাথে সম্পৃক্ত।

ইমাম গাজালি রহ. বলেন, যে ব্যক্তি নামাজের বাহ্যিক দিকটি লক্ষ্য রাখেন কিন্তু আধ্যাত্মিকতার প্রতি তেমন কোন গুরুত্ব দেন না, তার একটি দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির মত যে কোন একজন বাদশাকে একটি মৃত ছাগলের বাচ্চা উপহার দিল আর যে ব্যক্তি নামাজের জাহেরি কাজ গুলোতে শৈথিল্য প্রদর্শন করে তার দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে, কোন বাদশাকে একটি কান কাটা, উভয় চক্ষু নষ্ট এমন একটি জন্তু হাদিয়া দিলেন। মনে রাখতে হবে, এখানে এ দুই জন লোকই একজন বাদশা মানহানি করেছে এবং বাদশার মর্যাদাকে খাট করেছে। তবে উভয় ব্যক্তির অপরাধ অবশ্যই এক রকম নয়, ফলে তাদের উভয়ের শাস্তি ও এক রকম হবে না। তার পর ইমাম গাজ্জালি রহ. বলেন নিশ্চয় তুমি তোমার প্রভুকে তোমার নামাজ হাদিয়া দিচ্ছ, তোমাকে অবশ্যই এ ধরনের নামাজ হা দিয়া দেয়ার থেকে বিরত থাকতে হবে ,যে নামাজ দ্বারা তোমাকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়।

শেখ উসাইমিন রহ. রাসূল সা. এর কিয়ামুলাইল এবং তার সাহাবিদের কিয়ামুলাইলের আলোচনা করতে গিয়ে এক জায়গায় বলেন : বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ যেভাবে তারাবির নামাজ আদায় করেন তা সম্পূর্ণ শরিয়তের পরিপন্থী, তারা তারাবির নামাজ এত দ্রুত আদায় করে, নামাজের ওয়াজিব, নামাজে ধীরস্থিরতা এবং শান্তি সৃষ্ট তা বজায় ইত্যাদিতর প্রতি কোন গুরুত্ব প্রদান তারা করে না, অথচ এ গুলো নামাজের রুকন,যে গুলো আদায় ব্যতীত নামাজ শুদ্ধই হয় না। তারা তাদের পিছনের নামাজি- অসুস্থ, রুগি, দুর্বল এবং বৃদ্ধদের শুধু শুধু কষ্ট দেয় এবং তারা নিজেদের উপর অত্যাচার করে এবং অন্যদের উপরও অত্যাচার করে। বিজ্ঞ আলেমগন বলেন, একজন ইমামের জন্য এত তাড়াহুড়ো করা, যাতে তার পিছনে নামাজিরা সুন্নাত আদায় করতে পারে না, তাহলে তার নামাজ অবশ্যই মাকরূহ হবে। আর যদি ইমাম এমন তাড়াহুড়ো করে যার ফলে নামাজিরা তার পিছনে ফরজ আদায় করতেও সক্ষম হয় না, তার পরিণতি কি হতে পারে ? আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন।

শেখ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব রহ. কে তারাবির নামাজে তাড়াহুড়ো প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, তিনি প্রশ্ন কারিকে বলেন - তোমার কথা ইমাম তাড়াতাড়ি করলে তার পিছনে অনেক মানুষ নামাজ আদায় করবে আর যখন সে ধীরস্থির ভাবে নামাজ আদায় করে তখন তার পিছনে নামাজির সংখ্যা কমে যাবে- এর আলোকে আমি বলব, শয়তানের উদ্দেশ্য হল মানুষকে নেক আমল হতে বিরত রাখা, আর শয়তান যখন তা করতে সক্ষম হয়ে উঠে না, তখন তার জীবন মরণ চেষ্টা থাকে মানুষের আমলকে নষ্ট করা। দু:খের বিষয় হল, আমাদের দেশের অধিকাংশ ইমামরা তারাবির নামাজে এমন সব কাজ করে যা অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। তারা অর্থহীন নামাজ আদায় করে, তারা ঠিক মত রুকু করে না এবং ঠিক মত সেজদা করে না। অথচ ঠিক মত রুকু-সেজদা না করলে নামাজই শুদ্ধ হয় না।

মনে রাখতে হবে,মূলত: নামাজের উদ্দেশ্যই হল একাগ্রচিত্তে আল্লাহর সম্মুখে বিনয় ও নম্রতার সাথে দন্ডায়মান হওয়া এবং কোরান তেলাওয়াতে চলাকালে তা হতে উপদেশ গ্রহণ করা। কিন্তু নামাজের এ মহৎ উদ্দেশ্য তাড়াহুড়ো করে নামাজ আদায় করলে তা পূরণ হয় না। সুতরাং ইমামের সাথে তাড়াহুড়ো করে বিশ রাকাত আদায় করার চেয়ে ধীরস্থির খুশু ও বিনয়ের সাথে ইমামের পিছনে দশ রাকাত পড়াই উত্তম। রাকাতের আধিক্যের চেয়ে সুন্দরভাবে নামাজ আদায়ের প্রতি যত্নবান হও;আর ইহাই তোমার জন্য উপকারী ও সর্বোত্তম। আমরা যে কথাগুলো আলোচনা করলাম, এর উপরই আমল করা উচিত। আর যদি ইমাম ও মোক্তাদির মাঝে এ নিয়ে মতভেদ দেখা দেয় এবং মোক্তাদিরা তাড়াহুড়ো নামাজে অভ্যস্ত এবং তারা যদি ইমাম এর সাথে সুন্নাত অনুযায়ী নামাজ আদায় করতে অসম্মতি জানান তখনও ইমামের জন্য করণীয় হল, সে ধীরস্থির নামাজ আদায়ে উৎসাহী হবে এবং কোন ভাবেই নামাজে এমন তাড়াহুড়ো করবে না যাতে ধীরস্থিরতার বিঘ্ন হয়। এ সকল ক্ষেত্রে ইমাম সাহেবের জন্য নামাজে পূর্ণ রুকু সেজদা এবং ধীরস্থিরতা বজায় রেখে তাড়া হুড়া করে দীর্ঘ লম্বা কিরাত পড়ার চেয়ে ছোট কিরাত পড়া উত্তম।

অনুরূপ ভাবে দীর্ঘ কিরাত এবং রুকু সেজদায় ধীরস্থিরতা বজায় রেখে, দশ রাকাত নামাজ আদায় করা তাড়াহুড়ো করে বিশ রাকাত নামাজ আদায় করার তুলনায় উত্তম। কারণ, নামাজের আসল এবং চালিকা শক্তিই হল মানুষের মন আল্লাহর দিক ধাবিত হওয়া। অনেক সময় আছে তখন কম বেশির চেয়ে উত্তম হয়ে থাকে। কিতাবুস্সুনান ওয়াল মুবতাদিয়াত গ্রন্থকার বলেন,অনেক ইমামের নামাজ পাগলের নামাজের সাদৃশ্য। বিশেষ করে তারাবির নামাজ তিনি বলেন তাদের দেখা যায় তারা বিশ মিনিটে তেইশ রাকাত নামাজ আদায় করেন এবং প্রত্যেক রাকাতে তা সুরা আলা, দোহা এবং সুরা রহমানের এক চতুর্থাংশ পড়ে নামাজ শেষ করেন। এ ধরনের নামাজ সকলের ঐক্য মতের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ বাতিল, কারণ তাদের নামাজ হল মুনাফেকদের নামাজ সমতুল্য।

আল্লাহ মুনাফেকদের নামাজ সম্পর্ক বলেন: و إذا قاموا إلى الصلاة قاموا كسالى يراءون الناس ولا يذكرون الله إلا قليلا. এবং যখন তারা নামাজে দন্ডায়মান হয় তখন তারা অলসতা করে । তারা লোক দেখানো নামাজ আদায় করে। এবং তারা খুব কমই আল্লাহকে স্মরণ করে। তাদের নামাজ সফল মুমিনরেদর নামাজের মত নয় যাদের নামাজ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন: قد أفلح المؤمنون الذين هم في صلاتهم خاشعون. অবশ্যই ঐ সকল ঈমানদাররা সফল কাম যার তাদের নামাজে বিনয়ী।

তাদের নামাজ রাসূল সা. যে ধরনের নামাজ আদায় হতে বারণ এবং নিন্দা করেছেন -কাকের ঠোকর, নামাজে চুরি ইত্যাদি-সে নামাজের মতই নয়। আল্লামা দারমি আবুল আলিয়া হতে বর্ণনা করেন, আমরা বিভিন্ন লোকের নিকট হতে ইলম অর্জন করার জন্য উপস্থিত হতাম, তখন আমরা তার নামাজের প্রতি লক্ষ্য করতাম, যখন দেখতাম তার নামাজ সুন্দর,আমরা বলতাম তার অন্য সব কিছুই সুন্দর। আর যখন দেখতে পেতাম তার নামাজ অসুন্দর, আমরা তার থেকে দুরে সরে যেতাম এবং বলতাম তার অন্য সব কিছুই এর চেয়েও বেশি অসুন্দর।

তারাবির নামাজের জন্য ঈমাম টাকা চাইতে পারেন কি না?

প্রশ্ন : আমরা মসজিদে তারাবির নামাজ আদায় করি। যে মসজিদে আমরা তারাবি পড়ি, সেখানে তারাবির জন্য কোনো ইমাম নেই। এখন মসজিদের ইমাম সাহেব নামাজ পড়ানোর পরে বলেন, তারাবি পড়ানোর জন্য তাকে টাকা দিতে হবে। কিন্তু ইমাম সাহেব তো বেতন পান। বেতনের পরও যদি ইমাম সাহেব আবার টাকা চান মুসল্লিদের কাছে, সেটা কি ঠিক হবে?

উত্তর : ইমাম সাহেব তারাবির সালাতের জন্য বা কিয়ামু রমাদানের জন্য যদি টাকা চান এবং সেটা তিনি নিজেই যদি দাবি করে থাকেন অথবা শর্ত করে থাকেন, তাহলে একদল ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, তার এ কাজটি শুদ্ধ নয় বা এভাবে টাকা নেওয়াটা বৈধ নয়, জায়েজ নয়। তবে তারাবির সালাত হোক বা নফল সালাত হোক, একজন ব্যক্তি যদি পরিশ্রম করেন, সেক্ষেত্রে উচিত হবে তাকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করা। যারা ব্যবস্থাপনায় আছেন, তারাই এ ব্যবস্থা করবেন। এখন সাহায্য না করে যদি আপনি মনে করেন, ইমাম গোল্লায় যাক, তাতে আমার প্রয়োজন কী? তাহলে সালাতটা আদায় করবে কে? ইমামেরও তো পরিবার আছে, প্রয়োজন আছে। ইমাম সাহেব কি আপনার বাসায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করবেন, নাকি নিজের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করবেন? তাকে তো ভিক্ষাবৃত্তি করতে হবে। মসজিদে সালাত আদায় করার পর ইমাম সাহেব কি ভিক্ষাবৃত্তি করবেন?

আমাদের একটু বিবেক থাকা দরকার, সেটা হচ্ছে এই- ইমাম হোক বা মুয়াজ্জিন হোক, যেই হোক না কেন, তাদের বেতন এত কম যে এই বেতনে এই পৃথিবীতে থাকা প্রায় অসম্ভব। আমি এমন এক ব্যক্তিকে পেয়েছি, যিনি ৩০০ টাকা বেতনে চাকরি করছেন এবং বলেছেন যে আমি ৩৬ বছর এখানে কাজ করি। এখনো তার বেতন ৩০০ টাকা। আমরা কত জায়গায় কত টাকা অপচয় করি, কিন্তু ইমাম মুয়াজ্জিনকে টাকা দিতে কুণ্ঠিত হই। সেখানে আবার তারাবির সালাতে ইমাম সাহেব যদি টাকা চান, চাওয়াটা ইমাম সাহেবের ভুল কোনো সন্দেহ নেই। হয়তো ইমাম সাহেব বুঝতে পারেননি। কিন্তু ইমাম সাহেবকে টাকা চাইতে হলো কেন? তাকে চাইতে হওয়ার পরিবেশটা তৈরির পেছনে যারা আছেন, কোথায় তাদের ব্যবস্থাপনা? কোথায় উপলব্ধি? কোথায় ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা?

ইমাম সাহেবের টাকা চাওয়ার কারণটা এটাই, যারা ব্যবস্থাপনায় আছেন, তারা মানবিক নন, ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের দিকে তাদের দৃষ্টি তেমন স্পষ্ট নয়। একজন লোক ৩০ দিনে যদি কুরআনে কারিম খতম করেন, তাকে দিনের অনেকটা সময় এর পেছনে খাটতে হয়, এটা যথেষ্ট পরিশ্রমের কাজ। এখন সেখানে যদি তাকে কিছু সহায়তা না করা হয়, তাহলে তিনি কাজটি কীভাবে করবেন? এজন্য সেখানে বিবেকের বিষয় আছে, সেখানে যুক্তির বিষয় আছে। এগুলো সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান নিতে হবে। ইমাম সাহেব কেন চেয়েছেন, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো ইমাম সাহেবকে চাইতে হলো কেন?

নাবালেগ হাফেজের পেছনে তারাবি নামাজ পড়া জায়েজ হবে কী?

প্রশ্ন : অনেক মসজিদে দেখা যায়, ছোট ছোট হাফেজরা তারাবির নামাজ পড়ায়। এভাবে নাবালেগ হাফেজের পেছনে তারাবি নামাজ পড়া জায়েজ আছে কি? যদি না থাকে, তাহলে যে নামাজগুলো নাবালেগ হাফেজের পেছনে পড়া হয়েছে, তা কি কাজা করতে হবে?

উত্তর : তারাবির নামাজে নাবালেগের পেছনে বালেগের ইকতিদা সহিহ নয়। আর তারাবির যেহেতু কাজা নেই, তাই বিগত দিনের তারাবি কাজা করতে হবে না।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url